ওসীলা মৌলিকভাবে দুই প্রকার।
১-কোন নেক আমলের ওসীলা গ্রহণ।
২-কোন ব্যক্তিত্বের ওসীলা গ্রহণ।
প্রথম প্রকার ওসীলা তথা নেক আমলের ওসীলা জায়েজ এতে কোন সন্দেহ নেই। এটা সর্বসম্মত মতানুসারে জায়েজ। যা বনী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি পাহাড়ের গুহায় আটকে যাবার পর স্বীয় আমলের উসীলা দিয়ে দুআ করার দ্বারা সুষ্পষ্টরূপে প্রমাণিত। দ্রষ্টব্য- বুখারী-১/১৩৭}
ব্যক্তির উসীল গ্রহণের হুকুম:
হযরত আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং আওলিয়ায়ে কেরাম এবং বুজুর্গানে দ্বীনের ওসীলা দিয়ে দুআ করা ইসলামী শরীয়ত মোতাবিক জায়েজ। বরং দুআ কবুলের সহায়ক হওয়ার দরূন তা প্রশংসনীয় ও উত্তমও।
কুরআনে কারীমের আয়াত, হাদীসের বর্ণনা এবং জমহুর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর বক্তব্য দ্বারা একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত। এজন্য শর্ত হল ওসীলাকে মুআসসিরে হাকীকী তথা মূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী মনে করা যাবে না। এমনও মনে করা যাবে না যে, ওসীলা গ্রহণ ছাড়া দুআ কবুলই হবে না। এমন করা সুষ্পষ্ট গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা। সেই সাথে ওসীলা গ্রহণের উদ্দেশ্য এটাও নয় যে, আম্বিয়াগণ বা আওলিয়াগণ এর কাছে স্বীয় প্রয়োজন পূরণ করতে প্রার্থনা করা হবে। তাদের কাছে প্রয়োজন পূর্ণ করার ফরিয়াদ করা হবে। এটা শিরকী আক্বিদা ও পদ্ধতি এতে কোন সন্দেহ নেই। যেমনটি কতিপয় মুর্খ জাহেলরা করে থাকে।
যে ব্যক্তি দুনিয়াতে নেই তার ওসীলা দিয়ে দুআ করা জায়েজের দলীল:
وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِن قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا ﴿البقرة: ٨٩﴾
যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব এসে পৌঁছাল, যা সে বিষয়ের সত্যায়ন করে, যা তাদের কাছে রয়েছে এবং যা দিয়ে তারা ইতোপূর্বে কাফেরদের উপর বিজয় কামনা করতো। {সূরা বাকারা-৮৯}
বাগদাদের মুফতী আল্লামা সাইয়্যেদ মাহমুদ আলুসী রহঃ বলেনঃ
نزلت في بني قريظة والنضير كانوا يستفتحون على الأوس والخزرج برسول الله صلى الله عليه وسلم قبل مبعثه قاله ابن عباس رضي الله تعالى عنهما وقتادة والمعنى يطلبون من الله تعالى أن ينصرهم به على المشركين ، كما روى السدي أنهم كانوا إذا اشتد الحرب بينهم وبين المشركين أخرجوا التوراة ووضعوا أيديهم على موضع ذكر النبي صلى الله عليه وسلم وقالوا : اللهم إنا نسألك بحق نبيك الذي وعدتنا أن تبعثه في آخر الزمان أن تنصرنا اليوم على عدوّنا فينصرون
এ আয়াত নাজীল হয়েছে বনী কুরাইজা ও বনী নজীরের ব্যাপারে। রাসূল সাঃ এর আগমণের পূর্বে যারা আওস ও খাজরাজের বিরুদ্ধে রাসূল সাঃ এর ওসীলা দিয়ে দুআ করতো। এ বক্তব্যটি ইবনে আব্বাস রাঃ এবং কাতাদা এর।
আল্লাহ তাআলার কাছে চাওয়ার মানে হল, তারা এর দ্বারা মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতো। যেমন সিদ্দী বর্ণনা করেন যে, যখন তাদের ও মুশরিকদের মাঝে ভয়াবহ যুদ্ধ লেগে যেত, তখন তারা তাওরাত কিতাব বের করত, এবং তাদের হাত যেখানে রাসূল সাঃ এর নাম আছে তার উপর রাখতো, আর বলতো-“হে আল্লাহ! আমরা আজকে আপনার সাহায্য কামনা করছি আমাদের শত্র“দের বিরুদ্ধে ঐ সত্য নবীর ওসীলায় শেষ জমানায় যার আগমনের ওয়াদা আপনি করেছেন। তারপর তাদের সাহায্য করা হতো। {তাফসীরে রুহুল মাআনী-১/৩২০}
আল্লামা মহল্লী রহঃ উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ
রাসূল সাঃ এর আগমনের পূর্বে ইহুদীরা কাফেরদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য পার্থনা করে বলতো- اللهم انصرنا عليهم باالنبى المبعوث آخر الزمان তথা হে আল্লাহ! শেষ জমানায় আগমনকারী নবীর ওসীলায় আমাদের সাহায্য করুন। {তাফসীরে জালালাইন-১/১২}
একই তাফসীর নিম্ন বর্ণিত তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত।
যেমন-
১- তাফসীরে কাবীর-৩/১৮০।
২- তাফসীরে ইবনে জারীর তাবারী-১/৪৫৫।
৩- তাফসীরে বগবী-১/৫৮।
৪- তাফসীরে কুরতুবী-২/২৭।
৫- তাফসীরে আলবাহরুল মুহীত-১/৩০৩।
৬- তাফসীরে ইবনে কাসীর-১/১২৪।
৭- তাফসীরে আবীস সউদ-১/১২৮।
৮- তাফসীরে মাজহারী-১/৯৪।
৯- তাফসীরে রূহুল মাআনী-১/৩১৯।
১০- তাফসীরে ইবনে আব্বাস রাঃ-১৩।
১১- তাফসীরে খাজেন-১/৬৪।
১২- তাফসীরে মাদারেক-১/৩২।
১৩- তাফসীরে দুররে মানসূর-১/৮৮।
১৪- তাফসীরে তাবসীরুর রহমান আরবী-১/৫২।
১৫- সফওয়াতুত তাফাসীর-১/৭৭।
১৬- তাফসীরে আজীজী-৩২৯।
১৭- তাফসীরে মাওজাউল কুরআন-১৫।
১৮- তাফসীরে মাআরেফুর কুরআন [মাওলানা মুহাম্মদ ইদ্রিস কান্ধলবী রহঃ]- ১/১৭৭।
১৯- তাফসীরে জাওয়াহেরুল কুরআন- ৪৯।
২০- বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ লিইবনে কায়্যিম হাম্বলী-৪/১৪৫।
২১- আলমিনহাতুল ওহাবিয়া লিআল্লামা দাউদ বিন সুলাইমান আলবাগদাদী হানাফী রহঃ-৩১।
বিশেষ কথা:
উসুলে ফিক্বহ এ লিখা আছে যে, আল্লাহ তাআলা ও জনাবে রাসূল সাঃ যদি পর্ববর্তীদের শরীয়ত সমালোচনা বা নিষেধ করা ছাড়া বর্ণনা করে থাকেন, তাহলে সেটি আমাদের উপরও লাযেম হয়ে যায়। {নূরুল আনওয়ার-২১৬, তাসকীনুল কুলুব-৭৬, নেদায়ে হক্ব-১০১}
হযরত উসমান বিন হানীফ রাঃ থেকে ওসীলা জায়েজের প্রমাণ:
أن رجلا كان يختلف إلى عثمان بن عفان رضي الله عنه في حاجة له فكان عثمان لا يلتفت إليه ولا ينظر في حاجته فلقي عثمان بن حنيف فشكا ذلك إليه فقال له عثمان بن حنيف ائت الميضأة فتوضأ ثم ائت المسجد فصلي فيه ركعتين ثم قل اللهم إني أسألك وأتوجه إليك بنبينا محمد صلى الله عليه و سلم نبي الرحمة
এক ব্যক্তি হযরত উসমান বিন আফফান রাঃ এর কাছে একটি জরুরী কাজে আসা যাওয়া করত। হযরত উসমান রাঃ [ব্যস্ততার কারণে] না তার দিকে তাকাতেন, না তার প্রয়োজন পূর্ণ করতেন। সে লোক হযরত উসমান বিন হানীফ রাঃ এর কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগ করল। তখন তিনি বললেনঃ তুমি ওজু করার স্থানে গিয়ে ওজু কর। তারপর মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামায পড়। তারপর বল, হে আল্লাহ! তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। রহমাতের নবী মুহাম্মদ সাঃ এর ওসীলায় তোমার দিকে মনোনিবেশ করছি। {আল মুজামে সগীর, হাদীস নং-৫০৮, আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৮৩১১, আত তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস নং-১০১৮}
এ হাদীসের শেষে স্পষ্ট রয়েছে যে, লোকটি তা’ই করেছিল। তার দুই কবুলও হয়েছিল। ফলে হযরত উসমান রাঃ তাকে সম্মান দেখিয়ে তার প্রয়োজনও পূর্ণ করে দিয়েছিলেন।
হাদীসটির সনদ প্রসঙ্গে:
# উক্ত হাদীসটির ক্ষেত্রে ইমাম তাবরানী বলেনঃ والحديث صحيح তথা এ হাদীসটি সহীহ। {আল মুজামে সগীর-১০৪}
# আল্লামা মুনজিরী রহঃ ও একথার পক্ষাবলম্বন করেছেন। {আত তারগীব ওয়াত তারহীব-১/২৪২}
# আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী রহঃ বলেনঃ رواه التبرانى بسند جيد তথা তাবারানী রহঃ এটাকে উত্তম সনদে তা বর্ণনা করেছেন। {হাশীয়ায়ে ইবনে হাজার মক্কী আলাল ঈজাহ ফি মানাসিকিল হজ্ব লিননববী-৫০০, মিশর}
হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহঃ উক্ত হাদীস বর্ণনার পর লিখেনঃ
এর দ্বারা মৃত্যুর পর ওসীলা গ্রহণ করার বিষয়টিও প্রমাণিত। এছাড়া রেওয়ায়েত তথা বর্ণনার সাথে সাথে দিরায়াত তথা যৌক্তিকতার নিরিখেও তা প্রমাণিত।
কেননা, প্রথম বর্ণনা দ্বারা যে ওসীলা প্রমাণিত তা উভয় অবস্থাকেই শামীল করে থাকে। {নশরুত তীব-২৫৩}
একই বক্তব্য দেখুন- শিফাহুস সিক্বাম লিস সুবকী-১২৫, ওয়াফাউল ওয়াফা লিস সামহুদী-২/৪২০}
নিম্ন বর্ণিত ওলামায়ে কেরামও এ ওসীলাকে জায়েজ সাব্যস্ত করেছেন।
যথা-
১- আল্লামা সাইয়্যেদ সামহুদী- ওয়াফাউল ওয়াফা-২/৪২২।
২- আল্লামা তাজুদ্দীন সুবকী রহঃ- শিফাউস সিক্বাম-১২০।
৩- আল্লামা আলুসী হানাফী রহঃ- রূহুল মাআনী-৬/১২৮।
৪- শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ- হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা।
৫- শাহ মুহাম্মদ ইসহাক মুহাদ্দেসে দেহলবী- মিআতু মাসাঈল-৩৫।
৬- শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল শহীদ- তাক্ববিয়াতুল ঈমান-৯৫।
৭- মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্নৌবী- মাজমুআ ফাতাওয়া-৩/২৩।
৮- মাওলানা হুসাইন আলী সাহেব- বিলুগাতিল হিয়ার-১/৩৫৪।
৯- মুফতী আজীজুর রহমান, ফাতাওয়া দারুল উলুম দেওবন্দ-৫/৪৩১, ৪২৩, ৪২৪, ৪৪১।
১০- মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রহঃ- ফাতাওয়া রশীদিয়া-১/৭৮।
১১- মাওলানা মুফতী শফী রহঃ- মাআরেফুল কুরআন-১/৪২, ৪৪।
বুজুর্গদের ওসীলা দেয়া প্রসঙ্গ:
রাসূল সাঃ এর ওসীলা দেয়া যেমন জায়েজ, তেমনি বুজুর্গদের ওসীলা দেয়া ও জায়েজ আছে।
দেখুন-
১- ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ আলআবদারী আলমালেকী [ইবনুল হজ্ব]- মাদখাল-১/২৫৫}
২- আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী রহঃ- হাশীয়ায়ে ইবনে হাজার মক্কী আলালইজাহ ফী মানাসিকিল হজ্ব লিননাবাবী-৫০০।
৩- আল্লামা আলুসী রহঃ- রূহুল মাআনী-৬/১২৮।
৪- আশরাফ আলী থানবী রহঃ- নশরুত ত্বীব-৩০২-৩০৩।
৫- মুহাদ্দিসে কাবীর আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী- ইমদাদুল আহকাম-১/৪১।
৬- মাওলানা মুফতী মাহমুদ হাসান গঙ্গুহী রহঃ- ফাতাওয়া মাহমুদিয়া-৫/১৩৬-১৩৭}
৭- মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ জালান্ধরী রহঃ- খাইরুল ফাতাওয়া-১/১৯৮।
ইমামুল মুনাযিরীন মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ এর একটি ঘটনা:
আমি [মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ] যেদিন ওমরায় গেলাম। সেদিন সেখানে গিয়ে দুআ করছিলাম- اللهم اسئلك بمحمد نبيك ورسولك وحبيبك তথা হে আল্লাহ! তুমি তোমার নবীজী সাঃ এর ওসীলায় আমার দুআ কবুল কর!
সেখানে এক পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল- شرك شرك শিরক! শিরক!
আমি বললাম- ليس بشرك তথা এটা শিরক নয়। বরং এটি ওসীলা।
পুলিশ বললঃ توسل باالاعمال لا بالذات ওসীলা আমলের সাথে হয় ব্যক্তির সাথে নয়। অর্থাৎ কোন নেক কাজ করে দুআ চাও যে, হে আল্লাহ! আমার এ নেক আমলের বরকতে আমার দুআটি কবুল করুন। ব্যক্তির ওসীলা দিয়ে নয়। তথা এভাবে দুআ করবে না যে, হে আল্লাহ! এ ওলীর বরকতে আমার দুআ কবুল করুন। তাছাড়া আমল হল আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তি নয়”।
আমি জবাবে বললামঃ আল্লাহ তাআলা বলেছেন يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ তথা যাদেরকে তিনি ভালবাসেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। {সূরা মায়িদা-৫৪} আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে বলছেন তিনি ব্যক্তি সত্বাকে ভালবাসেন আর ব্যক্তিরাও তাকে ভালবাসে। উভয় দিকেইতো ব্যক্তি সত্বা। আমলতো নেই।
লোকটি জবাবে বললঃ ব্যক্তি প্রিয় হয় না, বরং আমল প্রিয় হয়।
তাদের মাঝে একটি ভাল গুণ হল এরা কুরআন শুনে চুপ হয়ে যায়। লোকটি চুপ হয়ে গেল। তারপর চলে যাচ্ছিল লোকটি। আমি আওয়াজ দিয়ে বললামঃ “কোন আমল দিয়ে আমি ওসীলা দিব?”
জবাবে লোকটি বলতে লাগলঃ প্রথমে দুই রাকাত নফল নামায পড়! তারপর দুআ কর এবং ওসীলা দিয়ে বল- হে আল্লাহ! এ দু রাকাত নামাযে ওসীলায় আমার দুআ কবুল কর!”
আমি বললামঃ আপনার আর আমার দুই রাকাত নামায আল্লাহর কাছে প্রিয়, অথচ রাসূল সাঃ আল্লাহর প্রিয় নয়? আশ্চর্য কথা বলছেনতো”।
আমার কথা শুনে লোকটি চলে গেল। {ইয়াদগার খুতুবাত}