Latest News



উমাইয়্যা বংশীয় খলিফা ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়া তার তিন বছরের শাসনামলে তিনটি বড় ধরনের অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল।


  • তার শাসনামলের প্রথম বছরে তার নির্দেশে ইমাম হুসাইন (আ.) সহ মহানবী (সা.)-এর পরিবারের পঞ্চাশজন শিশু, যুবক ও পৌঢ় ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়; 
  • দ্বিতীয় বছরে তার সেনাদল মদীনায় আক্রমণ চালায় এবং আশিজন সাহাবীসহ দশ হাজার লোককে হত্যা করে এবং এক হাজার মুসলিম নারীর শ্লীলতাহানি ঘটায়; 
  • তৃতীয় বছরে সে আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরকে দমনের উদ্দেশে মক্কায় আক্রমণের নির্দেশ দেয় ও তার সৈন্যরা পবিত্র কাবা গৃহে অগ্নিসংযোগ করে।

এ প্রবন্ধে আমরা খেলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইয়াযীদ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত পর্যন্ত তাঁকে হত্যার যে সকল প্রয়াস চালিয়েছিল, হত্যার নির্দেশ দিয়ে যে পত্রগুলো সে বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করেছিল এবং তাঁকে হত্যার পেছনে তার ভূমিকা থাকার অন্যান্য দলিল নিয়ে কয়েকটি শিরোনামে আলোচনা করব।



১. 

মদীনার গভর্নরের প্রতি ইয়াযীদের নির্দেশ : ‘হুসাইন বাইআত না করলে তাকে হত্যা কর’
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ইয়াযীদ কেবল তার নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার সাপেক্ষেই ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যা করা থেকে নিবৃত্ত হত। ঐতিহাসিক ইয়াকুবী লিখেছেন : ‘ইয়াযীদ মদীনার গভর্নর ওয়ালীদ ইবনে ওকবাকে এ মর্মে পত্র লিখে যে, যখন আমার পত্র তোমার হাতে পৌঁছবে তখন হুসাইন ইবনে আলী ও আবদুল্লাহ্্ ইবনে যুবাইরকে ডেকে পাঠাও এবং তাদের থেকে বাইআত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ কর। যদি তারা অস্বীকার করে, তবে তাদের মস্তক বিচ্ছিন্ন করে আমার নিকট প্রেরণ কর।’
এ নির্দেশের প্রেক্ষিতে ওয়ালীদ ইমাম হুসাইনকে স্বীয় প্রাসাদে ডেকে পাঠায়। ইমাম হুসাইন তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র আঁচ করে বনি হাশিমের যুবকদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। ওয়ালীদ ইমাম হুসাইনকে বাইআতের প্রস্তাব দিলে তিনি তার জবাবে বলেন : ‘হে আমীর! আমরা নবীর আহলে বাইত, রেসালতের খনি; আমাদের গৃহে ফেরেশতাদের আনা-গোনা হত, (তা ছিল) রহমত অবতীর্ণের ক্ষেত্র, মহান আল্লাহ্ সকল কল্যাণের শুরু করেছেন আমাদের থেকে এবং আমাদের মাধ্যমেই তার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। কিন্তু ইয়াযীদ হল দুষ্কৃতিপরায়ণ, মদ্যপায়ী, সে সম্মানিত ব্যক্তিদের হত্যাকারী এবং প্রকাশ্য পাপাচারী। সুতরাং আমার মত কেউ তার মত কারও হাতে বাইআত করতে পারে না।’
এরূপ জবাব শুনে ওয়ালীদ নিশ্চুপ থাকলেও মারওয়ান ইবনুল হাকাম ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যার পরামর্শ দেয়। ওয়ালীদ ইসলামের বিধান মতে ইমাম হুসাইনকে হত্যা জায়েয নয় বলে তা করতে অস্বীকার করে। এ খবর ইয়াযীদের নিকট পৌঁছলে সে ওয়ালীদকে লিখে পাঠায় : ‘যখন আমার পত্র তোমার হাতে পৌঁছবে তখন দ্বিতীয়বারের ন্যায় মদীনার জনগণের নিকট বাইআত নিবে এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরকে তার অবস্থায় ছেড়ে দাও। কারণ, সে আমাদের নিকট থেকে পালাতে পারবে না। কিন্তু হুসাইনকে হত্যা করে তার মাথা আমার নিকট পাঠিয়ে দাও। যদি তুমি তা কর, তবে তোমার জন্য উন্নত জাতের কিছু ঘোড়া ও আরো মূল্যবান অনেক উপহার পাঠাব।’
কিন্তু ইয়াযীদের পত্র ওয়ালীদের নিকট পৌঁছার পূর্বেই ইমাম হুসাইন মদীনা ত্যাগ করেছিলেন।
এর কিছুদিন পরই ইয়াযীদ ওয়ালীদকে দুর্বলতার অভিযোগে পদচ্যুত করে। এর কয়েক মাস পর ইয়াযীদ একইভাবে ইমাম হুসাইনের দূত মুসলিম ইবনে আকীলের তৎপরতার বিপক্ষে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগে কুফার গভর্নর নোমান ইবনে বাশীরকেও পদচ্যুত করে।

২. 

ইমাম হুসাইনের উক্তি : ‘আমাকে তারা হত্যা করবেই’
তাবারী বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.) মক্কায় এক জনসমাবেশে লোকদের উদ্দেশ করে বলেন : ‘তোমরা কি জান, ইবনে যুবাইর কি বলছে?’ লোকেরা বলল : ‘না, আমরা জানি না। আল্লাহ্্ আমাদের আপনার জন্য উৎসর্গিত করুন।’ ইমাম হুসাইন বললেন : ‘ইবনে যুবাইর আমাকে এ মসজিদে অবস্থানের কথা বলেছে এবং দাবি করেছে যে, আমার জন্য সৈন্য সংগ্রহ করবে। কিন্তু আমি আল্লাহ্্র শপথ করে তোমাদের বলছি, আমার জন্য মক্কার এক বিঘত দূরে নিহত হওয়া এর অভ্যন্তরে নিহত হওয়া অপেক্ষা শ্রেয়। আল্লাহ্্র শপথ, যদি আমি আত্মগোপন করি এবং কোন গুহায়ও আশ্রয় গ্রহণ করি, তবু তারা আমাকে খুঁজে বের করা পর্যন্ত বিশ্রাম গ্রহণ করবে না এবং তারা আমার সাথে তা-ই করবে যা তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
এ বিষয়গুলো থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইমাম হুসাইন (আ.) বনি উমাইয়্যার বিদ্বেষের তীব্রতা ও তাঁকে হত্যার অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবহিত ছিলেন।

৩. 

ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল
ইয়াকুবী বর্ণনা করেছেন : ‘হুসাইন (আ.) ইরাকের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন জানতে পেরে ইয়াযীদ কুফার গভর্নর হিসেবে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদকে নিয়োগ দান করে এবং তাকে এ মর্মে পত্র লিখে পাঠায় : আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, কুফার লোকেরা হুসাইনকে ইরাকে আসার আহ্বান জানিয়ে পত্র লিখেছে। আমি নিশ্চিত, সে কুফার দিকে যাত্রা করেছে... যদি তুমি তাকে হত্যা কর, তবে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। আর যদি তা না কর, তবে আমি তোমাকে তোমার মৃত পূর্ব-পুরুষদের নিকট পাঠিয়ে দেব। সুতরাং সাবধান! এ সুযোগকে হাতছাড়া কর না।’


ইবনে আসাম বর্ণনা করেছেন : ‘হুর ইবনে ইয়াযীদ রিয়াহি, উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদকে লিখে পাঠায় যে, সে ইমাম হুসাইনকে কারবালায় অবরুদ্ধ করেছে। এখন তার করণীয় কী?’ ইবনে যিয়াদ জবাবে লিখে : ‘আমীরুল মুমিনীন ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়া পত্র মারফত আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি তার নির্দেশ পালন না করলে আমার সাথে যথেচ্ছ আচরণ, এমনকি আমাকে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না।’
এ ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলো এ সাক্ষ্য প্রদান করে যে, ইয়াযীদ স্বয়ং উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের প্রতি ইমাম হুসাইনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল, এমনকি তার এ নির্দেশ পালন না করলে তাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিল।

৪. 

ইবনে যিয়াদ ইমাম হুসাইনের বিষয়ে নিজের থেকে কখনই কোন পদক্ষেপ নেয়নি
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত পর্যন্ত ইয়াযীদ ও ইবনে যিয়াদের মধ্যে অবিচ্ছিন্নভাবে যোগাযোগ ছিল। কারণ, ইয়াযীদ তাকে নির্দেশ দিয়েছিল সে যেন সবসময় তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এবং ছোট-বড় সব বিষয়েই তাকে পত্র (দূত) মারফত অবহিত করে। তাবারী লিখেছেন : ‘মুসলিম ইবনে আকীল এবং হানীকে হত্যার পর ইবনে যিয়াদ তাঁদের উভয়ের মাথা কেটে সিরিয়ায় ইয়াযীদের নিকট প্রেরণ করে। ইয়াযীদ তাদের কর্তিত মাথা দেখার পর বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে ইবনে যিযাদকে একটি পত্র লিখে। তাতে সে উল্লেখ করে : ‘আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে, হুসাইন কুফার দিকে যাত্রা করেছে। তার সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে তাদের প্রতি কড়া নজরে রাখ এবং তাদের শনাক্ত করার জন্য কুফায় গুপ্তচরদের নিয়োগ কর ও তাদের গ্রেফতার কর। যে কোন অজুহাতে হোক তার অনুসারীদের বন্দি কর। আর কুফায় যা-ই ঘটে না কেন, আমাকে অবহিত কর। তোমার ওপর আল্লাহ্ রহমত বর্ষিত হোক।’
ইবনে আসাকির বর্ণনা করেছেন : ‘যখন ইয়াযীদ জানতে পারে যে, ইমাম হুসাইন কুফার দিকে রওয়ানা হয়েছেন তখন সে ইবনে যিয়াদের নিকট দূত প্রেরণ করে নির্দেশ দেয় তাঁর সাথে যুদ্ধ করার ও তাঁকে (জীবিত অথবা মৃত) সিরিয়ায় পাঠানোর।’

ইবনে আসামের বর্ণনায় এসেছে : ইবনে যিয়াদ গভর্নর হিসেবে কুফায় প্রবেশের পরই কুফার জনগণের উদ্দেশে বক্তব্যে বলে : ‘ইয়াযীদ ইবনে মুআবিয়া আমার নিকট পত্র এবং চার হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ও দুই লক্ষ দিরহাম প্রেরণ করে এ অর্থ তোমাদের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। সে আরও নির্দেশ দিয়েছে যে, আমি যেন তোমাদেরকে তার শত্রু হুসাইন ইবনে আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠাই এবং তোমাদের তার আনুগত্যের দাওয়াত দেই।’

আল্লামা সুয়ূতী লিখেছেন : ‘ইয়াযীদ এক পত্রে তার নিযুক্ত কুফার গভর্নর ইবনে যিয়াদকে হুসাইনের সঙ্গে যুদ্ধের ও তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেয়।’
এ বর্ণনাগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, কুফায় যা কিছু ঘটত, ইয়াযীদ সে বিষয়ে শুধু অবহিতই ছিল না; বরং ইবনে যিয়াদ যা করত তা তার নির্দেশ অনুযায়ী ও তার অনুমতি সাপেক্ষেই করত। ফলে ইবনে যিয়াদের কর্মের দায় প্রথমত ইয়াযীদের ওপরই বর্তায়।





৫. 

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হত্যায় ইয়াযীদ আনন্দ ও দম্ভ প্রকাশ করেছিল
ইবনে আসাম, আবুল ফারাজ ইসফাহানী এবং ইবনে কাসির বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কর্তিত পবিত্র মাথা ইয়াযীদের নিকট নেয়া হলে সে আনন্দিত হয়ে ইবনে যেবারার নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করে তার মনোভাব প্রকাশ করে :

لعبت هاشم بالملک فلا خبر جاء و لا وحی نزل
لستُ مِن خندف ان لم انتقم مِن بنی احمد ما کان فعل
قد قتلنا قرم ساداتهم و عدلنا میل بدر فاعتدل

‘বনি হাশিম রাজত্ব নিয়ে খেলা করেছে। প্রকৃতপক্ষে কোন ঐশী বার্তাও আসেনি, আর কোন ওহীও অবতীর্ণ হয়নি। আমি যদি বনি আহমাদ অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশধরদের থেকে যা সে করেছিল তার প্রতিশোধ না নেই তবে আমি খিনদিফের (সন্তানদের) অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয় আমরা তাদের নেতাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়কে হত্যা করেছি এবং বদরের (নিহতের প্রতিশোধ গ্রহণ করে) সমান সমান হয়েছি।’
এ কবিতায় ইয়াযীদ রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াতকে অস্বীকার করেছে এবং ইমাম হুসাইনের হত্যাকে বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ বলে উল্লেখ করেছে। এভাবে সে তার অন্তরের বিশ্বাসকেই ব্যক্ত করেছে।
ইবনে আসির বর্ণনা করেছেন : ‘হুসাইনের শাহাদাতের পর তাঁর পবিত্র মাথা ইয়াযীদের কাছে প্রেরিত হলে সে তার হাতের লাঠি দিয়ে তাঁর গলায় আঘাত করে কবিতা পাঠ করছিল।’
যদি ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনের হত্যায় সন্তুষ্ট না হয়ে থাকে তবে কেন তাঁর গলায়, কোন কোন বর্ণনা মতে পবিত্র ঠোঁট ও দাঁতে আঘাত করে দম্ভের সাথে কবিতা আবৃত্তি করছিল। এ ঘটনায় ইমাম হুসাইনের প্রতি তার বিদ্বেষ সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছে।

আল্লামা সুয়ূতী লিখেছেন : ‘ইমাম হুসাইন ও তাঁর পিতার বংশের লোকদের হত্যার পর ইবনে যিয়াদ তাঁদের মস্তকগুলোকে সিরিয়ায় প্রেরণ করলে ইয়াযীদ প্রথমে আনন্দিত হয়, কিন্তু পরে যখন মুসলমানদের মধ্যে তার প্রতি অসন্তোষ ও ঘৃণার আশংকা করল তখন সে বাহ্যিকভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করে। সুতরাং মানুষের ইয়াযীদের প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়ার অধিকার রয়েছে।’

৬. 

ইমাম হুসাইনকে হত্যার পর ইয়াযীদ ইবনে যিয়াদকে পুরস্কৃত করেছিল
ইমাম হুসাইনকে হত্যার পর ইয়াযীদ, ইবনে যিয়াদকে তার পদে শুধু বহালই রাখেনি; বরং এ ঘটনার কয়েক মাস পর যখন সে তার সঙ্গে সিরিয়ায় দেখা করতে যায় তখন সে ইবনে যিয়াদকে আলিঙ্গন করে তার কপালে চুম্বন করে নিজ সিংহাসনের পাশে বসায় এবং এক গায়ককে তাকে সম্বর্ধনা দানের জন্য গান গাইতে বলে। সে তার সাকীকে মদ পরিবেশনের নির্দেশ দেয়। অতঃপর সে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ইবনে যিয়াদ ও ওমর ইবনে সাদকে দশ লক্ষ দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) দান করে। এমনকি সে এক বছরের জন্য ইবনে যিয়াদকে ইরাকের (কুফা ও বসরার) বার্ষিক খাজনার পুরোটাই গ্রহণের অনুমতি দেয়।

ইবনে আসির লিখেছেন : ‘ইমাম হুসাইনকে হত্যা করার পর ইবনে যিয়াদ তাঁর পবিত্র মস্তক ইয়াযীদের নিকট প্রেরণ করলে সে তার প্রতি খুবই খুশী হয়। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে যে, জনগণ তার এ কর্মে সন্তুষ্ট নয় তখন কৃত্রিমভাবে শোক প্রকাশ শুরু করে। এ কারণেই ইয়াযীদ তার মৃত্যু পর্যন্ত তাকে কুফার গভর্নর হিসেবে বহাল রাখে। এমনকি ইবনে যিয়াদই কুফার মিম্বারে ইয়াযীদের মৃত্যুর ঘোষণা দেয়।’
তাবারীও ইমাম হুসাইনকে হত্যা করার পর ইয়াযীদের নিকট ইবনে যিয়াদের মর্যাদা বৃদ্ধির বিষয় বর্ণনা করেছেন।



৭. 

আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ইয়াযীদকে ইমাম হুসাইনকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ইয়াযীদকে এক পত্রে লিখেন : ‘হে অবৈধ সন্তান! তুমিই হলে সেই ব্যক্তি যে তার পাপিষ্ঠ ও কলুষ হাত দিয়ে হুসাইনকে হত্যা করেছে। আমি কখনই এ কথা ভুলে যাইনি যে, তোমার হাত রক্তে রঞ্জিত। তুমি হুসাইনসহ বনি হাশিমের এমন ব্যক্তিদের হত্যা করেছ যাঁরা সকলেই উজ্জ্বল, দীপ্তিময় আলো এবং অন্ধকারে নিপতিতদের জন্য পথপ্রদর্শক তারকাস্বরূপ ছিলেন।’
ইবনে আব্বাস একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী এবং মহানবীর চাচা হযরত আব্বাসের সন্তান। তিনি কারবালার ঘটনার সময় জীবিত ছিলেন এবং ঐ ঘটনা সংঘটনের (আশুরার) দিনে তিনি দ্বিপ্রহরে স্বপ্ন দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) ক্রন্দনরত ও দুঃখভারাক্রান্ত অবস্থায় কারবালা ময়দান থেকে ইমাম হুসাইনের রক্ত সংগ্রহ করছেন। স্বপ্নেই রাসূল (সা.) তাঁকে ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের সংবাদ দেন। নিঃসন্দেহে তিনি ইয়াযীদকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেননি।

৮. 

কারবালার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হযরত যায়নাব বিনতে আলী (আ.) ইয়াযীদের সামনেই তাকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হত্যাকারী বলেছেন
মহানবী (সা.)-এর বংশের বন্দি নারী, শিশুসহ তাঁর আহলে বাইতের মহান ব্যক্তিদের পবিত্র মস্তকগুলো নিয়ে যখন ইবনে যিয়াদের সৈন্যরা সিরিয়ায় পৌঁছে তখন ইয়াযীদ তাদেরকে তার সামনে উপস্থিত করার নির্দেশ দেয়। ইমাম হুসাইনের পবিত্র মস্তকের ওপর ইয়াযীদের দৃষ্টি পড়া মাত্রই সে তার হাতের লাঠি দিয়ে তাঁর পবিত্র গলা, ঠোঁট ও দাঁতে আঘাত করতে থাকে এবং ইবনে যেবারার কবিতাটি আওরাতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে হযরত যায়নাব ইয়াযীদের উদ্দেশে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তার ইসলামের বাহ্যিক মুখোশ উন্মোচন করেন। তিনি ইয়াযীদের সকল কর্মকা-কে অনৈসলামিক এবং ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও গোত্রীয় আক্রোশপ্রসূত প্রমাণ করে এক দীর্ঘ বাগ্মিতাপূর্ণ বক্তব্য দান করেন। বক্তব্যের এক স্থানে তিনি বলেন :

‘হে ইয়াযীদ! তুই এ মহাঅপরাধ করার পর নিজেকে পাপী ও অপরাধী না ভেবে এবং এ অপরাধ কত বড় তা চিন্তা না করে বলছিস : ‘হায়! আমার পিতারা যদি এখানে উপস্থিত থাকত।’ তুই কি মনে করেছিস তারা এ কথা শুনে আনন্দে অভিভূত হয়ে তোকে বলত : ‘হে ইয়াযীদ! তোর হাত পঙ্গু না হোক।’ তুই এ ধরনের ঔদ্ধত্যমূলক কথা বলছিস এবং বেহেশতের যুবকদের সর্দারের দাঁতে আঘাত করছিস! তুই কতটা নির্লজ্জ! হ্যাঁ, এরূপ উদ্ভট ও অসংগত কথা তোর জন্যই সাজে। কারণ, তুই হচ্ছিস ঐ ব্যক্তি যে পূর্বের ক্ষতকে উন্মুক্ত করেছিস এবং যার হাত মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশধরদের রক্তে রঞ্জিত। তুই আবদুল মুত্তালিবের বংশের তারকাদের হত্যা করেছিস এবং আমাদের মূলকে কর্তন করেছিস। আর এখন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে পূর্বপুরুষদের ডাকছিস, আর ভাবছিস ওরা তোর আহ্বান শুনতে পাচ্ছে। শীঘ্রই তুইও তাদের সাথে মিলিত হবি এবং এমন শাস্তির সম্মুখীন হবি যে, তখন আকাক্সক্ষা করবি, যদি পূর্বেই তোর হাতগুলো পঙ্গু, আর তোর জিহ্বা মূক হয়ে যেত।’



৯. 

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ইয়াযীদকে তাঁর পিতার হত্যাকারী বলে সম্বোধন করেছেন
ইমাম যায়নুল আবেদীনও সিরিয়ায় অবস্থানকালে ইয়াযীদের উপস্থিতিতে কয়েকবার তাকে তাঁর পিতার হত্যাকারী বলে অভিহিত করেছেন। ইয়াযীদ ইমাম সাজ্জাদকে উদ্দেশ করে যখন বলে : ‘তুমি কি ঐ ব্যক্তির সন্তান যাকে আল্লাহ্ হত্যা করেছেন?’ ইমাম জবাবে বলেন : ‘আমি হলাম আলী, যার পিতাকে তুমি হত্যা করেছ।’ অতঃপর তিনি পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করেন :

وَ مَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَلِدًا فِيهَا وَ غَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَ لَعَنَهُ وَ أَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا

‘যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ্ তার প্রতি ক্রোধান্বিত হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’
যখন ইয়াযীদ লক্ষ্য করল যে, হযরত যায়নাব (আ.) এবং ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর বক্তব্য তার দরবারে উপস্থিত ব্যক্তিদেরও প্রভাবিত করছে এবং পরিবেশ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন সে তার মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে বলে। মুয়াজ্জিন আজানে রাসূল (সা.)-এর রিসালাতের সাক্ষ্য দান শুরু করলে ইমাম তাকে থামার নির্দেশ দিয়ে ইয়াযীদকে উদ্দেশ করে বলেন : ‘হে ইয়াযীদ! যে মুহাম্মাদ (সা.)-এর কথা তুমি বলছ; সে কি তোমার পূর্বপুরুষ, না আমার? যদি তুমি তাঁকে নিজের পূর্বপুরুষ বলে দাবি কর, তবে তুমি মিথ্যা বলছ। আর যদি তিনি আমার পূর্বপুরুষ হন তবে কেন তুমি তাঁর বংশধরদের হত্যা করেছ?’

১০. 

ইয়াযীদ সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি
আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ কিছু সংখ্যক আলেম ইয়াযীদের কাফির হওয়াকে নিশ্চিত বলেছেন এবং তাকে লানত করা জায়েয বলেছেন এবং তারা নিজেরাও তাকে লানত করেছেন। তন্মধ্যে আহমাদ ইবনে হাম্বাল, ইবনে যাওযী, কাযী আবু ইয়ালী, জাহিয, আল্লামা তাফতাযানী এবং আল্লামা সুয়ূতীর নাম উল্লেখযোগ্য।
আল্লামা তাফতাযানী বলেন : ‘ইমাম হুসাইনকে হত্যার পর ইয়াযীদের সন্তুষ্টি ও আনন্দ প্রকাশ এবং মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি তার নিকৃষ্ট আচরণ তার অসংখ্য মন্দ কর্মের কিছু নমুনা মাত্র যা বিভিন্ন গ্রন্থে ও সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আমরা তার বংশের পরিচয় দেখব না; বরং তার ঈমানের প্রকৃত অবস্থা দেখব। মহান আল্লাহ্ তাকে ও তার পক্ষাবলম্বীদের লানত করুন।’
ইয়াযীদের সকল গুরুতর অপরাধকে তুলে ধরে জাহিয বলেছেন : ‘এ বিষয়গুলো তার নিষ্ঠুরতা, কপটতা ও অধার্মিকতার প্রমাণ। নিঃসন্দেহে সে দুর্বৃত্ত ও অভিশপ্ত। যে কেউ তাকে সমর্থন করবে সে নিজেকেই অসম্মানিত করবে।’
বারযানজী তাঁর ‘ইশাআ’ গ্রন্থে এবং হাইসামী তাঁর ‘সাওয়ায়েকুল মুহরিকা’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন : ‘আহমাদ ইবনে হাম্বলকে তাঁর পুত্র যখন বলেন যে, আল্লাহ্ কিতাবে আমি ইয়াযীদকে লানত করার সপক্ষে কোন দলিল পাই না। তখন তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা মুহাম্মাদের ২২ ও ২৩ নং আয়াত দু’টি তেলাওয়াত করেন :

فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِن تَوَلَّيْتُمْ أَن أَن تُفْسِدُواْ فىِ الْأَرْضِ وَ تُقَطِّعُواْ أَرْحَامَكُم أُوْلَئكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَ أَعْمَى أَبْصَرَهُمْ

‘তোমরা কি আশা কর যে, তোমরা কর্তৃত্বের অধিকারী হলে ভূপৃষ্ঠে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে থাকবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? (যারা এরূপ করবে) তারাই হল সে সকল লোক যাদের আল্লাহ্ অভিসম্পাত (স্বীয় রহমত হতে দূর) করেন এবং তাদের কর্ণে বধিরতা ও তাদের চক্ষুতে অন্ধত্ব সৃষ্টি করেছেন।’
অতঃপর তিনি বলেন : ‘ইয়াযীদ যা করেছে তার থেকে বড় কোন বিপর্যয় ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার নমুনা আছে কি?’

আল্লামা আলুসী বলেন : ‘যদি কেউ বলে ইয়াযীদের কোন দোষ ছিল না এবং সে কোন অপরাধ করেনি, তাই তাকে লানত করা যাবে না; নিঃসন্দেহে সে ইয়াযীদের অন্যতম সহযোগী এবং তার দলের অন্তর্ভুক্ত।’ 


  • তথ্যসূত্র
  • ১. তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খ-, পৃ. ২৪১; ইবনে আসাম, আল ফুতুহ, ৩য় খ-, ৫ম অধ্যায়, পৃ. ১০-১১।
  • ২. ইবনে আসাম, আল ফুতুহ, ৩য় খ-, ৫ম অধ্যায়, পৃ. ১৫-১৮।




0 Comments:

Post a Comment

:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top
Blogger Template